মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী


ভূমিকাঃ


সৃষ্টি জগতের সর্বকালের সেরা মানব তিনি হচ্ছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ। তিনি এই সৃষ্টি জগতের শেষ নবি ও রসুল সাঃ। দুনিয়া সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে যত নবি ও রাসুল এই দুনিয়াতে এসেছেন তাদের মধ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রসুল। এই মহামানবের উপর অবতীর্ণ হয় মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ হচ্ছেন মানব জাতির মুক্তির দূত ও পথ প্রদর্শক। 


পেজ সূচীপত্রঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী


জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ


মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ পবিত্র মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ই আগস্ট (১২ই রবিউল আউয়াল) মাসে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমেনা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জন্মের পূর্বেই তার পিতা কে হারান। জন্মের ৬ বছর পর তার মা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। তার মায়ের মৃত্যুর পর তিনি দাদা আব্দুল মুত্তালিব এর কাছে লালিত পালিত হন। 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর বয়স যখন ৮ বছর তখন তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও তাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। দাদার মৃত্যুর পর তার ঠায় হয় চাচা আবু তালিব এর কাছে। চাচার আফুরুন্ত ভালোবাসায় শিশু নবি বড় হতে থাকেন। চাচা আবু তালিব ছিলেন একজন ব্যবসায়ী তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করতেন,সে জন্য শিশু নবি সাঃ ও তার চাচার সাথে ছোট বেলা থেকেই দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন এবং বাকি সময় তিনি ভেড়া চড়াতেন। 

নাম ও উপাধিঃ


মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ শৈশব কাল থেকেই অত্যন্ত সহজ সরল ও কমল স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, অপরিসীম কর্তব্যবোধ, ধর্ম জ্ঞানে অনন্য চারিত্রিক বিশিষ্টের অধিকারী ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ। তিনি ছিলেন সদা সত্যবাদী ও আমানতদার, তিনি কখনো কারো আমানতের খেয়ানত করেননি। সে জন্য মক্কার মানুষেরা ভালবেসে তাকে আল-আমিন ( বিশ্বস্ত, সত্যবাদী ) নাম উপাধি দেন । 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর পুরো নাম ছিলো, আবুল কাশিম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আব্দ মানাফ আল কুরাইশি। এর বাংলা অনুবাদ করলে দেখা যায় : কুরাইশ গোত্রের আব্দুল মানাফের পুত্র হাশিম, হাশিমের পুত্র আব্দুল মুত্তালিব, আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ সাঃ। সংক্ষেপে তাকে আবুল কাশিম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ নামেও ডাকা হতো। 

ওহি ও কোরআনের সূচনাঃ


আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নবি ও রাসুলদের প্রতি প্রেরিত বার্তাকেই ওহী বলা হয়। ওহী শব্দের মৌলিক অর্থ হচ্ছে গোপনীয়তা ও দ্রুততা। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে এমন গোপন ও দ্রুত সংবাদ যা শুধু ওই ব্যক্তিই জানেন, যার প্রতি তা প্রেরন করা হয়েছে। সিরাতের বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর বয়স যখন ৪০ বছর এর আশেপাশে তখন তিনি প্রায় সময় তিনি মানুষজন থেকে দূরে গিয়ে একা একা থাকতে শুরু করেন। এই ঘটনা প্রায় ২ বছর ধরে চলতে থাকে। তিনি মক্কার অদূরে জাবালে নূর (নূর পাহার) পর্বতের হেরা নামক গুহায় ধ্যানে মগ্ন থাকতেন।

৬১০ খ্রিষ্টাব্দের রমযান মাসের শবে কদরের রাতে তিনি ধ্যানমগ্ন থাকাকালীন সময়ে আল্লাহর নিকট হতে প্রেরিত ফেরেশতা জিবরাঈল আঃ এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম ওহী প্রেরন করা হয়। জিবরাঈল আঃ হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর কাছে এগিয়ে এসে বললেন "পড়ুন" কিন্তু মুহাম্মদ সাঃ ছিলেন নিরক্ষর সেটা তিনি অকপটে স্বীকার করে বললেন যে, আমিতো পড়তে জানিনা। অবশেষে জিবরাঈল আঃ নিজেই আয়াত গুলো পড়ে শুনান এবং মুহাম্মদ সাঃ সেই আয়াত গুলো মুখস্থ করেন।

প্রথম প্রেরিত ওহী " পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাধা রক্তপিন্ড হতে। বলুন আপনার রব মহামান্নিত, যিনি কলমের সাহায্যে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না "। (সূরা আলাক, আয়াত ১-৫) এখান থেকেই কোরআন ও ওহীর সূচনা হয়।  ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ মহানবী সাঃ এর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যে সব ওহী নাযিল হয় সেই সকল সূরা ও আয়াত দ্বারা মহাগ্রন্থ আল-কোরআন গঠিত হয়।

মক্কায় ইসলাম প্রচারঃ


মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর উপর ওহী নাযিলের কিছু দিন পর আল্লাহ তায়ালার আদেশক্রমে তিনি ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তার এই ডাকে সর্ব প্রথম সাড়া দেন তার প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা রাঃ। তিনিই হলেন প্রথম ইসলাম গ্রহন করা নারী। তারপর ইসলাম গ্রহন করেন হযরত আবু বকর রাঃ। তারপর চাচা আবু তালিবের পুত্র কিশোর সাহাবী হযরত আলী রাঃ এবং জায়েদ ইবনে হারেসা। এরপর ৩ বছর ধরে মুহাম্মদ সাঃ শুধু তার আত্মীয় স্বজন ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিকট ইসলাম প্রচার করেন। 

ক্রমেই মহানবী সাঃ এর আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে ইসলামে দীক্ষিত মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কুরআনে বর্ণিত, সূরা হিজরের ৯৪ নাম্বার আয়াত " কাজেই আপনাকে যে বিষয়ের হুকুম দেওয়া হয়েছে তা প্রকাশে জোরে শোরে প্রচার করুন, আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন " অবতীর্ণ হওয়ার পরে মহানবী সাঃ সাফা মারওয়া পাহাড়ে উঠে সমস্থ মক্কার জনগণকে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহন ও মুসলমান হওয়ার আহবান জানান। কিন্তু মক্কার বেশির ভাগ সাধারন মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক। 

তারা প্রথমে মুহাম্মদ সাঃ এর নবুয়ত প্রাপ্তির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেনি। সেজন্য মহানবী সাঃ শুরুতে মক্কা নেতাদের থেকে তেমন কোন বাধার সম্মুখীন হননি। তারা ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে ছিল উদাসীন। কিন্তু কিছুদিন পরে উত্তেজনায় চরম বৃদ্ধি পায়। কারণ মুহাম্মদ সাঃ এর ইসলাম প্রচার মক্কার অভিজাতদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের ঘোষণা দেওয়ার পর মক্কার বিধর্মী কুরাইশরা ক্ষীপ্ত হয়ে মহানবী সাঃ কে হত্যার চেষ্টা এবং তার অনুসারীদের উপর নানারকম অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু করে দেয়। 

মদিনায় হিজরত ও সনদঃ


কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর আদেশে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ হযরত আবু বক্করকে সঙ্গী করে মক্কা ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত আবু বকরকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আদেশ প্রদান করেন। এর পূর্বে মক্কার মুসলমানরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে হয়ে মদিনায় হিজরত করেন। যার ফলে মক্কার অধিকাংশ মুসলমান অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মদিনায় স্থানান্তরিত হয়। যার ফলে শুধুমাত্র  মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর পরিবার এবং কাছের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাদের পরিবারের লোকজন মক্কায় অবশিষ্ট ছিল। 

যার মধ্যে অন্যতম ছিল হযরত আলী রাঃ ও হযরত আবু বকর রাঃ। এই দুজনের মধ্যে হযরত আবু বকরকে সফর সঙ্গে হিসেবে বেছে নেন এবং হযরত আলীকে মহানবীর কাছে থাকা কিছু আমানত তাদের মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়ার জন্য মক্কায় রেখে যেতে চেয়েছিলেন। অপরদিকে কুরাইশ বিধর্মীরা আলোচনা করেন যে, ইসলাম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের (কুরাইশদের) বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ধর্মব্যবস্থার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এজন্য তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। এবং সে আলোচনা অনুযায়ী এ কাজের জন্য বিভিন্ন গোত্র থেকে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী তরুণ যুবককে মহানবী হযরত মুহাম্মদ কে হত্যার জন্য নির্বাচিত করা হয়। 

যখন হযরত মুহাম্মদ সাঃ মক্কার কুরাইশদের হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার বিষয়ে খবর পেলেন তখন তিনি হযরত আবু বক্করকে সাথে নিয়ে তার ঘর থেকে গোপনে বেরিয়ে গেলেন। এবং হযরত আলী রাঃ কে মহানবী সাঃ এর পরিধান করা পোশাক পরিধান করে তার বিছানায় শুয়ে পড়েন। যে কারণে হত্যা কারীরা ভেবেছিল যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাসাল্লাম এখনও ঘরে আছেন, কিন্তু ইতিমধ্যে হযরত আবু বকরকে সাথে নিয়ে তিনি মক্কা নগরী থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। হত্যা কারীরা ঘরে ঢুকে যখন দেখেন মহানবী সাঃ নেই তখন তারা পাগলের মত চারিদিকে খুঁজতে শুরু করেন।

এ সময় মোহাম্মদ সাঃ ও হযরত আবু বকর রাঃ শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের গুহায় তিন দিন পর্যন্ত লুকিয়ে ছিলেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে তুলনামূলক নিরাপদ রাস্তা ধরে পাহাড়ি গিরিপথ ও মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাত্রা করেন এবং অবশেষে অগণিত বাধা অতিক্রম করে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর মদিনায় পৌঁছান। হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মদিনায় এই আগমনকেই 'হিজরত' বলা হয়। মদিনার পূর্ব নাম ছিল ইয়াসরিব। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর আগমনের পর তাঁর সম্মানার্থে নাম রাখা হয় মদিনাতুন নবী বা নবীর শহর।  

সসস্ত্র যুদ্ধের সূচনাঃ

যখন মদিনায় শান্তি শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠিত হয় তারপর মহানবী হযরত মুহাম্মদ একটি গণশুমারি পরিচালনা করা সিদ্ধান্ত নেন। কেননা মক্কার বিধর্মী করেদের সাথে যুদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার। জনশুমারি শেষে জানা যায় ৫০০ যুদ্ধ করার মত সক্ষম। এই সময়ে সূরা হজ্জের ৩৯ নম্বর আয়াত "যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে বিজয় ধানের সক্ষম" অবতীর্ণ হয় মুসলমানদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়। 

হিজরতের পূর্বে ১২বছরের সময়কালে মুসলমানদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি, শুধু ধৈর্যধারণের কথা বলা হয়েছিল। মুসলমানদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সামরিক শক্তির অভাব ছিল। হিজরতের প্রথম অথবা দ্বিতীয় বছরে কেবলমাত্র মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে উপরোক্ত কোরআন এর আয়াতের (সূরা হজ, আয়াত ৩৯)  নাযিলের মাধ্যমে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। বদরের যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ। যা সংঘটিত হয় ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের, দুই হিজরির সনের ১৭ রমজান মাসে।  

ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয় হেজাজ অঞ্চলের বদর নামক একটি এলাকায়।  বদর প্রান্তর মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথের  কেন্দ্রে অবস্থিত। ইসলামী ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব ছিলেন স্বয়ং মোঃ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং এর বিপরীত নেতৃত্বে ছিলেন আবু জেহেল। এই যুদ্ধটি বদর আল কুবরা যুদ্ধ নামেও পরিচিত, যা সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্য নির্বাচক দিন হিসেবে স্মরণীয় থাকবে। মূলত এ যুদ্ধের সূচনা হয় একটি বাণিজ্যিক কাফেলা কে লক্ষ্য করে পরিচালিত অভিযানের মাধ্যমে। 

যে বাণিজ্য কাফেলা কে লক্ষ্য করে অভিযান পরিচালনা করা হয় সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার পথে কুরাইশদের একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্য কাফেলা যার নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। মুসলমানদের কাছে এই কাফেলাটি প্রতিকারের সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা ঐ কাফেলায় থাকা বিশাল সম্পদের অধিকাংশই ছিল মুসলিমদের মালিকানাধীন, যা কুরাইশ বিধর্মীরা মুসলমানদের থেকে জোর করে অত্যাচার নিপীড়নের মাধ্যমে হাসিল করেন। মোঃ কাফেলার গতিপথ জানার জন্য গোয়েন্দা পাঠান এবং তথ্য প্রাপ্তির পর উদ্দেশ্যে অভিযান অংশগ্রহণের আহবান জানান। 

সূচনা হয় প্রতারিতি অনুসারে একক দ্বন্দ্ব যুদ্ধের মাধ্যমে। মুসলিমদের পক্ষ থেকে আসে হযরত হামজা, হযরত আলী এবং হযরত উবায়দা এবং মুশরিকদের পক্ষ থেকে উতবা, সাইবা  এবং আল-ওয়ালিদ। এই দ্বৈতযুদ্ধে কোরিয়া নিহত হন। এ যুদ্ধে কুরাইশদের সরমতো 70 জন নিহত এবং সত্য জন মুসলিমদের নিহত হন ১৪ জন যাদের মধ্যে আটজন ছিলেন আনসার সাহাবী মুজাহির সাহাবী। বদর যুদ্ধ ছিল মুসলিমদের জন্য প্রথম সামরিক বিজয় এই যুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশকে রাজনৈতিকভাবে বৈধতা দেয়। 

মক্কা বিজয়ঃ

ইসলামের ইতিহাসে মক্কা বিজয় ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক ঘটনা। যা (৬৩০ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারী)  ৮ হিজরী সনের ২০ রমজান মাসে সংঘটিত হয়। মক্কা অভিযানের মূল পটভূমি ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গের মাধ্যমে, চুক্তি অনুযায়ী মুসলিম গোত্র  গুলোর মধ্যে শান্তি বজায় রাখার কথা ছিল। কিন্তু কুরাইশরা সে চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমান বন্ধু গোত্রে হামলা চালান, হামলাকৃত মুসলিম গোত্র প্রতিনিধি দল মদিনায় এসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর কাছে বিচারের আবেদন করেন তখন তিনি চূড়ান্তভাবে মক্কায় অভিযানের নির্দেশ দেন।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ মক্কা অভিযানের এই পরিকল্পনা অত্যন্ত গোপনীয় রাখেন, এমন ভাবে গোপন রাখেন যে তার ঘনিষ্ঠ সাহাবীরাও এর উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না। মক্কা অভিযানের দিকে অগ্রসর হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ছোট একটি বাহিনীকে অন্যদিকে পাঠান যাতে করে মক্কার কুরাইশদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। মক্কা মক্কা বিজয় অভিযানে মুসলিম বাহিনী সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার, এই বাহিনীতে ছিলেন আনসার, মুজাহির এবং বন্ধু গোত্রের বাহিনী। মক্কার দর্পণে পৌঁছালে মুসলিম বাহিনী চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, যার মধ্যে মাত্র একটি অংশে যুদ্ধের ঘটনা ঘটে।

মক্কা বিজয় ছিল প্রায় রক্তপাতহীন। মুসলিম বাহিনীর একটি দল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে অগ্রসর হলে কিছু কোরাইশ যোদ্ধা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে।  যার নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে ওমর ইবনে হিশাম। এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে কুরাইশদের ১২ জন এবং মুসলিমদের পক্ষ থেকে দুইজন নিহত হয়। এই যুদ্ধে সহজেই মুসলিমরা জয়লাভ করে এবং মক্কা সম্পূর্ণরূপে মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। মক্কায় প্রবেশের পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ কাবায় প্রবেশ করে তাওয়াফ করেন এবং কাবা ঘরের চারপাশে প্রায় ৩০০ টা মূর্তি ভেঙে ফেলেন এবং কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন "সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত  হয়েছে"।

মক্কা বিজয়ের পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সকল বিধর্মীকেও ক্ষমা করা হয়। যার ফলে বহু বিধর্মী নেতা যারা আগে ইসলামের বিরোধিতা করত তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের ফলে কুরেসদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অবসান ঘটে এবং ইসলাম আরব দেশের এক নতুন শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও মদিনা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র কিন্তু মক্কা হয়ে ওঠে ইসলামের ধর্মীয় প্রাণকেন্দ্র। এই বিজয় 'আল-ফাতহুল আজিম' বা মহা বিজয় নামে পরিচিত। 

বিদায় হজের ভাষণঃ


বিদায় হজের ভাষণ ইসলামী ইতিহাসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক একটি ঐতিহাসিক ভাষণ। যা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের দশম হিজরির জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে তিনি বিদায় হজ পালনের পর আরাফাহর ময়দানে উরানাহ উপত্যকায় এক লক্ষ মানুষের সামনে বিদায় হজের এই ভাষণ দেন।এই ভাষণে মোহাম্মদ সাঃ মুসলিম উম্মাহকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিলেন , যা আজও মুসলিম বিশ্বে পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ভাষণটি মুসলিমদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা তাদেরকে পরকালের সাফল্যের পথ দেখায়। 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ ভাষনে বলেন, হে জনগণ!  আল্লাহর কসম, আমি জানিনা আজকের পরে আর কোনদিন তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে মিলিত হতে পারব কিহতে পারব কি-না।অতএব আল্লাহর রহম করুন ওই ব্যক্তির উপরে যে আজকে আমার কথা শুনবে ওটা স্মরণ রাখবে।কেননা অনেক জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নয় (সে অন্যান্য নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়)  এবং অনেক জ্ঞানের বাহক তার চাইতে অধিকতর জ্ঞানীর নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। জেনে রেখো, জেনে রেখো নিশ্চয়ই তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের রক্ত তোমাদের পরস্পরের উপরে হারাম। 

যেমন আজকের এই দিন হারাম, এই মাস হারাম, এই এই শহর তোমাদের জন্য হারাম খারাপ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম )।শুনে রাখ, জাহেলী যুগের সকল কিছু আজকে আমার পায়ের তলে পিষ্ট হলো। চাহিলে যুগের সকল রক্তের দাবি পরিত্যক্ত হলো। আমাদের রক্ত সমূহের প্রথম যে রক্তের দাবি আমি পরিত্যাগ করছি, তা হলো রাবি'আহ ইবনুল হারেস বিন আব্দুল মুত্তালিব -এর শিশু পুত্রের রক্তের দাবি। যে তখন বনু সা'দ গোত্রে দুগ্ধ পান করছিল, আর হোযাইল গোত্রের  লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল। চাহিলি যুগের সকল সুদ পরিত্যক্ত হলো।

আমাদের সুদ সমূহের প্রথম যে সুদ আমি শেষ করে দিচ্ছি সেটি হলো আমার চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব এর পাওনা সুদ। যার সবটুকু বাতিল করা হলো। তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে তাদেরকে হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের প্রাপ্য হক হল এই যে, তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে মারাতে দেবে না, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ কর। তোমাদের উপরে তাদের প্রাপ্য হক হলো খাদ্য ও পরিধেয় প্রদান করা। আর মনে রেখো, আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি এমন এক বস্তু, যা মজবুতভাবে ধারণ করলে পথভ্রষ্ট হবে না। সেটি হলো আল্লাহর কিতাব। 

জেনে রাখ, তিনটি বিষয়ে মুমিনের অন্তর কখনো খেয়ানত করে না (১) মমিন ব্যক্তি যা করে সম্পন্ন আল্লাহকে খুশি করার জন্য ইখলাসের সাথে করে । (২) শাসক বর্গের কল্যাণ কামনা করা, সে যদি দেখতে কুৎসিত ও হয় আর ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী আদেশ করেন তার হুকুম পালন করা। (৩)মুমিনরা সব সময় মুসলমানদের জামাতকে আঁকড়ে ধরে,কেননা তাদেরকে পিছন থেকে (শয়তানের প্রতারণা হতে) রক্ষা করে। অর্থাৎ মমিন যতক্ষণ এই তিনটি স্বভাবের উপর দৃঢ় থাকবে ততক্ষণ তার অন্তর খেয়ানত করবে না। যা তাকে জ্ঞান প্রচারের কাজে বাধা দেয়, আর তিনি হবেন প্রকৃত  মমিন।  

মহামানবের মৃত্যুঃ


মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষক্রিয়ায়  আক্রান্ত করে হত্যা করা হয়েছিল। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মহানবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাম খাইবার বিজয়ের পর এক ইহুদী নারীর বাড়িতে খাবার খান,  ওই নারীর নাম ছিল জয়নব।যুদ্ধে নিহত তার আত্মীয়-স্বজনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মোহাম্মদ সাঃ কে বিষাক্ত খাসির মাংস খেতে দেন এবং তিনি সাথে সাথেই বিষয়টা বুঝতে পারেন এবং সাহাবীদেরকে নিষেধ করেন, তবে সেখানেই একজন সাহাবী বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।  এই ঘটনার পর দীর্ঘদিন তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ থেকে ফিরে আসার পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তে তার পাশে ছিলেন স্ত্রী হযরত আয়েশা রাঃ এবং তার কন্যারা। মৃত্যুর সময় তিনি আয়েশা রাঃ এর কোলে মাথা রেখে দুনিয়াতে শেষ বাক্য শাহাদাহ "সর্বোচ্চ বন্ধুর জন্য" পাঠ করেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই জুন মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে মসজিদে নববীর পাশে মা আয়েশার ঘরের পাশে সমাহিত করা হয়। 


শেষ কথাঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, মহানুভবতার প্রতীক। তিনি ছিলেন একজন মহামানব, যিনি পৃথিবীতে শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। মহানবী সাঃ অত্যন্ত সৎ গুনের অধিকারী ছিলেন, অত্যন্ত শান্ত, নম্র, বিনয়ী ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। যিনি পুরো জীবনে কোনদিন একটা মিথ্যা কথা বলেনি, সদা সর্বদা সত্য কথা বলেছেন। হাজারো অত্যাচার, নিপীড়ন এর পরেও সত্যের উপরে অটল থেকেছেন আজীবন। 

আমরা সেই মহামানবের উম্মত, আমাদের সকলের উচিত তাকে অনুসরণ করা এবং তার মত সহজ সরল জীবন যাপন করা। তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, তার সুন্নাহ কে আঁকড়ে ধরা, যাতে করে কিয়ামতের মাঠে বিচারের দিনে আল্লাহর নিকট তার সুপারিশ প্রাপ্ত হতে পারি। 


এই আর্টিকেল টি এমন একজন মহা মানব কে নিয়ে লেখা যার পায়ের ধুলার যোগ্য ও আমি না। অতএব যদি এই লেখার মধ্যে ভুল কোন তথ্য দিয়ে থাকি অবশ্যই সমাধানের জন্য হলেও আমাকে জানাবেন, ধন্যবাদ। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

শিক্ষা বাজার এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url